বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর ২০২৪, ০৬:০০ অপরাহ্ন

সংবাদ শিরোনাম :
টেকনাফ ছাড়াও এবার নতুন করে উখিয়া-নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্তে ভেসে আসছে বিস্ফোরণের বিকট শব্দ চকরিয়ায় জেলা পরিষদের জমিতে নির্মিত আওয়ামী লীগের অফিস উচ্ছেদ সেন্টমার্টিন দ্বীপে পর্যটন নিয়ন্ত্রণ ও জাহাজ ছাড়ার পয়েন্ট নির্ধারণ সংক্রান্ত কমিটি গঠণ সব নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের দাবিতে কক্সবাজার শহরে এসে সেন্টমার্টিন দ্বীপবাসির সড়ক অবরোধ পাহাড়ী আস্তানা থেকে মালয়েশিয়া পাচারকালে শিশুসহ ৩১ জন উদ্ধার, দুই দালাল আটক সাবের মন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজীর পিএস ফিরোজ কক্সবাজারে গ্রেপ্তার মিয়ানমারের বাঘগুনা খালের পাশে রয়েছে নিমার্ণ সামগ্রী ও দুইটি ট্রলার, মাঝি-মাল্লা সহ ১১ জনের হদিস নেই মিয়ানমারের উপজাতি সম্প্রদায়ের ৬৫ নাগরিকের অনুপ্রবেশ চকরিয়ায় কিশোরকে ছুরিকাঘাত : আটক ৪ চকরিয়ায় ফেরিওয়ালার ঝুলন্ত মরদেহ উদ্ধার

যাদের অস্ত্র ছিল গান

বিডিনিউজ : অস্ত্র হাতে মুক্তিযোদ্ধারা মাঠে-ময়দানে লড়েছেন নয় মাস। সে সময় মুক্তিপাগল সেসব বীর সেনানীদের মানসিকভাবে শক্তি যোগাতে অন্যরকম এক যুদ্ধে নেমেছিলেন আরেকদল যোদ্ধা, তারা ‘কণ্ঠযোদ্ধা’।

শক্তিশালী কণ্ঠকে হাতিয়ার করে মা-মাটি-দেশের কথা ছড়িয়ে দিতেন তারা, ইথারে ভেসে রক্তে নাচন তোলা সেসব গান পৌঁছে যেত মুক্তিযোদ্ধাদের কানে। এই কণ্ঠযোদ্ধারাই তাদের বারবার ঘুরে দাঁড়ানোর শক্তি যুগিয়েছেন।

শুধু মুক্তিযোদ্ধারাই নন, ১৯৭১ সালে কোটি কোটি বাঙালিরও অনুপ্রেরণা হয়েছিলেন শব্দ সৈনিকেরা।

১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ ‘স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র’ প্রতিষ্ঠিত হয়। পরে ২৮ মার্চ ‘বিপ্লবী’ শব্দটি বাদ দিয়ে ‘স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র’ নাম রাখা হয়। ২৫ মে কলকাতার বালীগঞ্জ সার্কুলার রোডে এর নতুন কেন্দ্র চালু হয়।

সেই বেতার কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার তথ্য পেয়ে দেশ ছেড়েছিলেন শিল্পী অরূপ রতন চৌধুরী। স্বাধীনতা যুদ্ধের আগে ‘বিক্ষুব্ধ শিল্পীগোষ্ঠীর’ হয়ে আবদুল লতিফ শেখ, লুৎফর রহমান, অজিত রায়দের নেতৃত্বে গণসংগীত করতেন তিনি।

যুদ্ধের শুরুতে ‘বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক সংস্থার’ হয়ে তিনি এবং সরদার আলাউদ্দিন একমাস আগরতলার বিভিন্ন ক্যাম্পে গান করেছিলেন। এরপর তাদের পাঠিয়ে দেওয়া হয় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে।

অরূপ রতন চৌধুরী জানান, মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি সার্বক্ষণিক বেতার কেন্দ্রে থেকেই গান করতেন।

একাত্তরে স্বাধীনতার ঘোষণা প্রচার স্টেশন চট্টগ্রামের কালুরঘাট স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র
একাত্তরে স্বাধীনতার ঘোষণা প্রচার স্টেশন চট্টগ্রামের কালুরঘাট স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র

“দুইতলা ভবনের নিচতলায় ছিল ডাইনিং এবং রান্নাঘর। উপরের তলায় একদিকে আমরা থাকতাম, অন্যদিকে একটা স্টুডিও ছিল। গৌরিপ্রসন্ন মজুমদার আসলেন বা শহীদুল ইসলাম বা যারা গান লিখতেন, তারা গান লিখতে বসতেন।

“তারপর সুরকার সুজেয় শ্যাম, সমর দাসরা গান সুর করতে বসত। এই করতে করতে সন্ধ্যা হয়ে যেত। তারপর পুরো রাত রেকর্ডিং হতো। সকালে ঘুমাতে যেতাম। এভাবেই আমাদের দিনের পর দিন কেটেছে।”

‘পূর্ব দিগন্তে সূর্য ওঠেছে’, ‘তীর হারা এই ঢেউয়ের সাগর’, ‘নোঙ্গর তোল তোল’সহ একাধিক গানে কন্ঠ দেওয়া এই শিল্পীকে জুন মাসের দিকে পল্লীগীতি শিল্পী হরলাল রায় ‘জ্বলছে জ্বলছে প্রাণ আমার দেশ আমার’ শিরোনামে একটি গান করার কথা বলেন। গানটি লিখেছিলেন শহীদুল ইসলাম। ইংরেজি সংবাদ পাঠিকা নাসরীন আহমদের সাথে তিনি গানটি গেয়েছিলেন।

অরূপ রতন বলেন, “গানটা প্রচারের সময় আমাদের নাম ঘোষণা করা হয়। সেদিন প্রথম বেতার থেকে আমার নাম প্রচার হয়, দেশ থেকে আমার মা-বাবা জানতে পারল; আমি বেঁচে আছি। না হলে তো জানত না।”

তখন শিল্পীদের পাশাপাশি স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রও পাকিস্তানী গুপ্তচরদের নজরে ছিল। আগরতলা থেকে কলকাতায় যাবার দিনই অরূপ রতনের পিছু নিয়েছিল গুপ্তচররা।

“বেতার থেকে সবকিছু প্রচার হত তো- মুক্তিযোদ্ধারা কোন কালভার্টটা উড়ায় দিছে, কোন এলাকা দখল করেছে, কোন রাজাকারকে মেরে ফেলছে। পাকিস্তানী আর রাজাকারদের লক্ষ্য ছিল, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র খুঁজে বের করে উড়িয়ে দেয়া। এজন্য ভারতীয় সেনাবাহিনী সবসময় সিভিল ড্রেসে আমাদের পাহারা দিত।”

বেতার কেন্দ্রের পাশাপাশি বিভিন্ন শরনার্থী ক্যাম্পেও গান করেছেন অরূপ রতন চৌধুরী। গান গেয়ে উপার্জন করা অর্থ চলে যেত মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্যে।

এই দন্ত বিশেষজ্ঞ সম্প্রতি ‘বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ ও বেতার কেন্দ্র’ নামে একটি বই লিখেছেন।

তাতে তিনি উল্লেখ করেছেন, সাতই মার্চের পরই বেতার কেন্দ্র চালু করার নির্দেশনা দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু।

“এটা কিন্তু উনার নির্দেশনা ছিল, এটা অনেকে জানেও না, বলেও না।”

অরূপ রতন চৌধুরী
অরূপ রতন চৌধুরী

এই শিল্পী বলছেন, স্বাধীন বাংলা বেতারের শিল্পী নন, এমন অনেকেই নিজেকে বেতারের শিল্পী হিসেবে দাবি করছেন।

ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি বলেন, “এখন সবাই বলে, আমি স্বাধীন বাংলা বেতারের শিল্পী। তাদের অনেকের চেহারাও তখন দেখিনি। আমি তো সবসময় বেতার কেন্দ্রেই থাকতাম, তাদের দেখিনি।”

স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের আরেক শিল্পী তিমির নন্দী বলছেন, সাংস্কৃতিক অঙ্গনের যুদ্ধটা শুরু হয়েছিল ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান থেকেই।

“তখন শিল্পীরা মঞ্চে, ট্রাকে করে প্রতিবাদী, গণসংগীত, দেশাত্ববোধক গান করে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করত।”

১৯৬৯ সাল থেকে রেডিও-টেলিভিশনে গান করে আসা তিমির নন্দী মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে বেড়াতে গিয়ে আটকা পরেন কুড়িগ্রামে আত্মীয় বাড়িতে। সেখানে তিনি ভাতৃবধূর ভাই দেবব্রত বক্সী বুলবুলের মাধ্যমে স্থানীয় শিল্পীদের সাথে গান করতেন। বুলবুল ছিলেন একাধারে গীতিকার, সুরকার, নাট্যকার, অভিনেতা।

“উনি (বুলবুল) আমাদের গান শেখাতেন। সেগুলো গেয়ে আমরা কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট অঞ্চলের মানুষকে উদ্বুদ্ধ করতাম। পাকিস্তানী আর্মি যখন রংপুর চলে এলো, তারপর আমরা গ্রামের দিকে চলে যাই। আর্মি গ্রামে চলে আসার পর, আমরা নৌকা ভাড়া করে আসাম হয়ে কলকাতা চলে যাই।”

১৪ বছরের তিমির নন্দী শুরুতে চেয়েছিলেন সরাসরি যুদ্ধ করতে। তবে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের গান শুনে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন কন্ঠ দিয়ে যুদ্ধ করতে।

তারপর খোঁজ নিয়ে সন্ধান পান বেতার কেন্দ্রের, সেখানে গিয়ে দেখা পান অজিত রায়, লাকী আখন্দের।

মেঝো ভাইয়ের ছেঁড়া স্যান্ডেল পরে বাসে-ট্রামে করে, কখনও হেঁটে বেতার কেন্দ্রে যেতেন তিনি। সময় পেতেন না খাওয়ার, এমনকি গোসলেরও।

পরিতোষ সাহা
পরিতোষ সাহা

“না খেয়ে আছি, একটা সিঙ্গারা হয়ত চারজনে ভাগ করে খাচ্ছি, এক কাপ চা সেটাও ভাগ করে খাচ্ছি। এভাবেই দিন কেটেছে। কিন্তু যে কষ্টটা গেছে, সেটাকে কিন্তু কখনও কষ্ট মনে করিনি। কারণ তখন আমার মাথার মধ্যে ঘুরছে, যারা ফ্রন্টে আছেন তাদের তো আমাদের চেয়েও বেশি কষ্ট। তাদের তো যেকোনো সময় জানটা চলে যেতে পারে। আমাদের মাথার মধ্যে ছিল, দেশ এবং বঙ্গবন্ধুকে মুক্ত করতে হবে।”

স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের বাইরে তিনি ‘শরণার্থী শিল্পী গোষ্ঠী’র হয়েও গান করেছিলেন। সংগঠনটির নেতৃত্বে ছিলেন আব্দুল মান্নান।

“এটা হয়েছিল কলকাতার নারকেল ডাঙ্গায়। সংগঠনটিতে ছিলেন নাট্যকার মামুনুর রশীদ, রফিকুল আলম, অনুপ ভট্টচার্য, ফকির আলমগীর, মিতালি মুখার্জী, দীপা খন্দকার, রেখা দাস, শুক্লা দে, কমল সরকার, বিপ্লব দাস।

“মামুন ভাই আর বিপ্লব দাস স্ক্রিপ্ট লিখতেন। চিত্রনাট্য, গীতিনাট্য এগুলো আমরা বানিয়ে কলকাতা, কলকাতার বাইরে এবং সীমান্তে মুক্তিযোদ্ধাদের উজ্জীবিত করতাম। সেখান থেকে আমরা যে পারিশ্রমিক পেতাম সেটা মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ তহবিলে দান করতাম।”

স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের আরেক শিল্পী কল্যাণী ঘোষের পরিবার পাকিস্তানী ও তাদের দোসরদের অত্যাচারে চট্টগ্রাম শহর ছেড়ে গ্রামের বাড়ি রাউজানে যেতে বাধ্য হয়েছিল।

তিনি জানান, সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীদের অত্যাচারে সেখানেও ঠাঁই মেলেনি, পরে গভীর রাতে বোরকা পরে, মুখে কালি মেখে পাড়ি জমান সীমান্তের দিকে।

“কোথায় যাচ্ছি বলতে পারছি না। পেছনে রাজাকাররা আমাদের তাড়া করছে। ‍তখন আমার কোলে পৌঁনে দুই বছরের সন্তান। মা, বাবা, ভাই-বোন, প্রবালের (শিল্পী প্রবাল চৌধুরী) অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী, সবাই মিলে দেশ ছেড়েছিলাম।

“এখন কথাগুলো ইজিলি বলছি, কিন্তু সেসময় যে কি গেছে; মার্চ মাস আসলে আমাদের সমস্ত শরীরের লোম দাঁড়িয়ে যায়।”

এপ্রিল মাসে রামগড় বর্ডার দিয়ে আগরতলা পৌঁছান তারা। ছোট বোন উমার (শিল্পী উমা খান) জলবসন্ত হওয়ায় সেখানে থাকতে হয়েছিল কয়েক দিন। পরে মে মাসের শুরুতেই কলকাতায় গেলেও খোঁজ পাননি স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের।

এরই মধ্যে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে এক অনুষ্ঠানে গান গাইতে যান তিনি, সেখানেই ১৯৬২ সাল থেকে কালুরঘাট বেতারে গান করা কল্যাণী ঘোষের দেখা হয় সানজিদা খাতুনের সাথে।

কল্যাণী ঘোষ
কল্যাণী ঘোষ

“আমাদের গান শুনে উনি উনার সংগঠন ‘বাংলাদেশ মুক্তি সংগ্রামী শিল্পী সংস্থা’তে যোগ দিতে বলেন, যেটা পরবর্তীতে ‘মুক্তির গান’ নাম হয়েছিল। পরদিনই আমরা যোগ দিয়েছিলাম। তাদের সাথে ট্রাকে ট্রাকে বিভিন্ন শরণার্থী শিবিরে, মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পে বৃষ্টিতে ভিজে, রোদে পুড়ে গান করেছি। এই গ্রুপটা তৈরি করেছিলেন জহির রায়হান, আলমগীর কবির, মোস্তফা মনোয়ার, সৈয়দ হাসান ইমাম, কলকাতার দীপেন বন্দ্যোপাধ্যায়রা।”

জুনে ওই সংগঠনের মহড়া থেকে ফেরার পথে গড়িয়াহাটার মোড়ে আব্দুল জব্বার ও সমর দাসের সাথে তার দেখা হলে তারা তাকে বেতার কেন্দ্রে নিয়ে যান।

“প্রতিদিন রেকর্ডিং থাকত। একটানা আমাদের দুই-তিনটা গান রেকর্ড করতে হত। গান লিখছে, তখনই সুর করছে, তখনই রেকর্ড করতে হচ্ছে। কাদেরী কিবরিয়া, অনুপ ভট্টাচার্য, অরূপ রতন চৌধুরী, লাকী আখন্দ, রমা ভৌমিক, মাধুরী আচার্য এরা ছিল। ফাঁকে ফাঁকে যখন সময় পেতাম তখন সমর দাসের নেতৃত্বে গান গেয়ে চাঁদা তুলতাম।”

কখনও ছোট শিশুকে নিয়েও ক্যাম্পে গান করতে যেতেন জানিয়ে কল্যাণী ঘোষ বলেন, “বাসে, ট্রেনে, ট্রাকে করে যেতাম। ঠাণ্ডার মধ্যে তার তেমন জামাও ছিল না। মাঝে মাঝে ওকে বাবা-মার কাছেও রেখে যেতাম, কিন্তু বাবা অসুস্থ ছিল।”

এই শিল্পী বলেন, তাদের অস্ত্র ছিল একমাত্র কণ্ঠ; যা দিয়ে তারা গণজাগরণমূলক গান করতেন।

“সবচেয়ে তীক্ষ্ণ যেটা সেটা আমার কণ্ঠ। দশটা গায়িকা গান করত, আমি একা। আমাকে মাইক্রোফোন থেকে ৪/৫ হাত দূরে দাঁড় করাতো সমর দা, তারপরও আমার কণ্ঠটাই যেত।”

তখন তিনি বাংলাদেশি শিল্পীদের নিয়ে ‘বাংলাদেশ তরুণ শিল্পী’ গোষ্ঠী নামে একটি সংগঠন করেছিলেন। সেখানে ২৫-৩০ জন শিল্পী গান করতেন।

“ওই গোষ্ঠীর জন্য মোহিনী মোহন চক্রবর্তী স্ক্রিপ্ট লিখেছিলেন। এর মধ্যে সমস্ত গান এবং বায়ান্ন থেকে একাত্তর পর্যন্ত সব ঘটনা লেখা থাকত। উনি স্ক্রিপ্ট পড়তেন আর আমরা এর ফাঁকে ফাঁকে গণসংগীত করতাম।”

এই সংগঠনের শিল্পীরা আসানসোল, জামসেদপুর, বর্ধমান, দুর্গাপুর, নদীয়া, কল্যাণী, বসিরহাট, রানাঘাট, বারাসাত, মেদীনীপুর, ঝাড়গ্রাম, কলামন্দির, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন স্থানে মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষে জনমত গঠনের জন্য গান করতেন।

কল্যাণী ঘোষ বলেন, “ভারতের জনতার দরবারে গিয়েছি আমরা। কিন্তু এ সংগঠনের অনেকেই এখনও মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি পায়নি।”

প্রবাল চৌধুরী, স্বপন চৌধুরী খোকা, রথীন্দ্রনাথ রায়, কাদেরী কিবরিয়া, বিপুল ভট্টাচার্য, রফিকুল আলম, সারওয়ার জাহান, হরলাল রায়, অরূপ রতন চৌধুরী, উমা খান, পূর্নীমা দাস, ত্রীদিব চৌধুরী, মিতালী মুখার্জী, সুজিত রায়, এম এ মান্নানসহ আরও অনেকে এ সংগঠনের সাথে যুক্ত ছিলেন।

তিমির নন্দী
তিমির নন্দী

কঠিন সেইসব দিনের স্মৃতিচারণ করে তিনি বলেন, “ওরা যে কী কষ্ট করেছে! একটা সিঙ্গারা খেয়ে ‍দিন কাটত। সে বছর ভারতে অসম্ভব ঠাণ্ডা পরেছিল। কোনো গরম কাপড় ছিল না, তাও স্কুল ঘরে ফ্লোরিং করতাম। ফ্লোরে চাদর-টাদর কিছুই থাকত না। ঠাণ্ডায় কাঁপতে থাকতাম।”

রুমা গুহঠাকুরতার ‘ক্যালকাটা ইয়ুথ কয়্যার’ সংগঠনটির মাধ্যমেও তিনি বিভিন্ন জায়গায় মুক্তিযুদ্ধের গান গেয়েছেন।

কল্যাণী ঘোষ জানান, দেশপ্রেম আর বঙ্গবন্ধুর সাতই মার্চের ভাষণ শুনে উজ্জীবিত হয়েই কন্ঠ যুদ্ধে নেমেছিলেন তিনি।

“এক কাপড়ে দেশ ছেড়ে চলে গিয়েছিলাম, হাতে ‍ছিল আধা সের চাল। আড়াইদিন হেঁটে হেঁটে গেছি। মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়াটা আমাদের জন্য বিরাট সৌভাগ্যের। সবাই তো সুযোগটা পায়নি।”

কল্যাণী ঘোষের অভিযোগ, মুক্তিযুদ্ধের সময়ের গানগুলোর শব্দ নতুন রেকর্ডিংয়ের সময় বদলে ফেলা হচ্ছে। এছাড়া যারা স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শিল্পী ছিলেন না, তারাও বেতারের শিল্পী পরিচয় দিচ্ছে।

“‘জোয়ার এসেছে গণসমুদ্রে’ ছিল গানটা, আর তারা রেকর্ড করছে জনসমুদ্রে। প্রতিটা জায়গায় বলছি, কিন্তু এ কথাগুলো কেউ শুনছে না। সেখানে ৫০-৫৫টা গান গেয়েছি। প্রতিটা গান বেশি হলে ১৪ জন মিলে গেয়েছি। কিন্তু এখন তো ১৫০-২০০ জন নিজেকে বেতারের শিল্পী বলছে।”

৩২ বছর বাংলা একাডেমিতে কাজ করে কল্যাণী ঘোষ অবসর নেন ২০০৪ সালে।

তিনি জানিয়েছেন, মুক্তিযোদ্ধা হওয়ায় বাংলা একাডেমিতে তার পদোন্নতি হয়নি।

“২০০৪ সালে বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক আমাকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, আপনি কি জনতার মঞ্চে গান গেয়েছেন?”

মুক্তিযুদ্ধের সময় পরিতোষ সাহার অস্ত্র ছিল তবলা। দুই হাতে তুলতেন ঝড়।

যুদ্ধের শুরুতে তিনি ফরিদপুর থেকে হেঁটে ভারতে যান। কলকাতার কোকাকোলা বিল্ডিংয়ে দেখা হয় ফরিদপুরের রাজনীতিবিদ ওবায়দুর রহমানের সাথে। তার কাছে গিয়ে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে যোগ দেওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করলে, তিনি পরিতোষ সাহাকে যুদ্ধে যেতে বলেন।

“আমি বললাম, ‘আমরা গান-বাজনার লোক; আমরা কি যুদ্ধ করতে পারব?’ যদিও ফরিদপুরে একমাস ট্রেনিং নিয়েছিলাম। তারপর আপেল মাহমুদ আর আবদুল জব্বার উনার কাছে আসার পর, তিনি তাদের আমাকে বেতারে নিতে বলেন।”

শুরুর দিকে তিনি মহড়ার সময় তবলা বাজাতেন। তারপর বহরমপুর, সল্টলেক, বাটখোলাসহ বিভিন্ন শরণার্থী ক্যাম্পে তবলা বাজিয়েছেন।

“মিহির কর্মকার, অরুণা সাহা এদের সাথে পাঁচ-ছয় জনের একেকটা গ্রুপ করে আমাদের পাঠাত। তখন আমাদের কষ্ট করে হাতে করে তবলা, হারমোনিয়াম নিয়ে যেতে হত।”

নিউজটি শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

.coxsbazartimes.com

Design & Developed BY ThemesBazar.Com
themesbcox1716222888